জাহাঙ্গীর বাদশার রিপোর্ট, তমলুক: ভারতছাড়ো আন্দোলনের এক অজানা নাম সাবিত্রী দেবী। তমলুকের শহীদ মাতঙ্গিনী হাজরা কে সবাই চেনেন। কিন্তু এই বীরাঙ্গনা নারীর কথা খুব একটা মানুষ জানে না। কিন্তু ৪২ এর আগস্ট আন্দোলনের সময় টার ও ভূমিকা ছিল অপরিহার্য! পেশাগত কারণে তারা সমাজের পতিতা ছিলেন। কিন্তু তা সত্বেও দেশ সেবায় নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বদেশী আন্দোলনে।
এই মহিলার কাহিনী শুনলে অবাক হবেন। বীরাঙ্গনা সাবিত্রী দেবী পতিতা থেকে হয়ে উঠলেন স্বাধীনতা দেওয়া সংগ্রামী জানুন সেই কাহিনী। শহীদ মাতঙ্গিনী হাজরার নামের সঙ্গে আর একজনের নাম উল্লেখের দাবী রাখে ইতিহাস, তিনি হলেন "সাবিত্রী বালা দেবী। সাবিত্রী বালা দে।" কে এই সাবিত্রী দেবী! কী তাঁর অবদানের ইতিহাস!
ইংরেজ পুলিশের গুলিতে যখন সেদিন অসংখ্য দেশপ্রেমিক রক্তাক্ত হয়ে, আহত হয়ে মাটিতে পড়ে একফোঁটা জলের জন্য বুক- ফাটা কাতরতায় কাতরাচ্ছে। সেই আর্তির কণ্ঠ-নিসৃত আর্তনাদের খবর পেয়েই স্থানীয় এক গ্রাম্য মহিলা, যার নাম সাবিত্রী দেবী, তিনি সমস্ত মৃত্যু-ভয়কে উপেক্ষা করে, ছুটে গিয়েছিলেন তমলুক থানার কাছে শঙ্করআড়া পোলেতে এবং মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকা আহত-রক্তাক্ত বিপ্লবী দেশপ্রেমিকদের মুখে তুলে দিয়েছিলেন পরম যত্নে পিপাসার জল। নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন সেই দেশমাতৃকার সন্তানদের সেবা-শুশ্রুষায়। আহতদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্তও তিনি করেছিলেন।
সাবিত্রী দেবী আহতদের সেবা-শুশ্রুষা করছেন, তখন ইংরেজের দলদাস, পদলেহনকারী পুলিশের দল সেদিন রাইফেল উঁচিয়ে সাবিত্রী দেবীকে ভয় দেখিয়ে গুলি করে মেরে ফেলার হুঙ্কার- হুমকিও দিয়েছিল বারবার। এমনকি ইংরেজ পুলিশ বাহিনী বন্দুক উঁচিয়ে তেড়ে আসে, সাবিত্রী দেবী বাড়ি থেকে ঝাঁটা ও বঁটি হাতে ইংরেজ বাহিনীর দিকে এগোতে থাকে।
এবং তার সঙ্গে আরও অনেক বারাঙ্গনা মহিলা বঁটি ও ঝাঁটা হাতে ইংরেজ বাহিনীকে ধাওয়া করে। অকুতোভয় সাবিত্রী দেবীকে তারা সেদিন দমাতে পারেনি। তাঁর সেই রণংদেহী মূর্তি দেখে ইংরেজ পুলিশ বাহিনীও সেদিন থমকে গিয়েছিল।
বীরাঙ্গনা সাবিত্রী দেবী ছিলেন তথাকথিত সমাজচ্যুত এক বারাঙ্গনা নারী। এই ঘটনা সেদিন সারা বাংলা তথা সারা ভারতবর্ষ-কে বিস্মিত করেছিল- একজন অবহেলিত, অপমানিত, উপেক্ষিত, গ্রাম্য দরিদ্র মহিলা কিভাবে বীরাঙ্গনায় রূপান্তরিত হন— তার প্রামাণ্য নিদর্শন দেখে। এই প্রসঙ্গে সেই যুগের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে এই খবর প্রকাশিত হয়েছিল, যেমন, যুগান্তর, বসুমতী, আনন্দবাজার প্রমুখ পত্রিকাতে। পত্রিকাগুলিতে সাবিত্রী দেবীর বীরগাথা নিয়ে চারনকবির একটি কবিতাও প্রকাশ হয়।
যদিও এহেন বীরাঙ্গনা নারীর শেষ জীবন ছিল অত্যন্ত কষ্টের। চরম দারিদ্রের মধ্যে দিয়ে কাটে তাঁর জীবন। একটি হতশ্রী মাটির ঘরে, মাটির উনুন, ভাঙা তোবড়ানো একটি এ্যালুমিনিয়ামর থালা, শতচ্ছিন্ন কাপড় জামা, কোনদিন খেতে পেতেন, আবার কোনদিন ছিল নিরম্বু উপোস।
এই ছিল তাঁর দৈনন্দিন জীবন। সবশেষে সবার চক্ষুর আড়ালে থাকা সেই বীরাঙ্গনা নারী একদিন নীরবে চলে গেলেন চিরদিনের বিদায় নিয়ে ১৯৯৪ সালে।
0 মন্তব্যসমূহ